ভাতের_গন্ধ পর্ণালী_ব্যানার্জী
চৈতী সমানে ঘর আর বাইরে করছে। প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল অর্ককে ছয়টা ডিম আনতে পাঠিয়েছে সে। সেটা নিয়ে এখনো ছেলেটা ফিরলো না। ফোনটাও নিয়ে বের হয়নি অর্ক। খুব চিন্তা হচ্ছে। ছেলেটা গেল কোথায়! এখনো কেন ফিরছে না...
কিছু পরে অর্ক ফিরলো। কোথায় ডিম, ছেলের হাতে তো দু প্যাকেট ধূপকাঠি।
-- "কিরে ডিম কই?"
-- "আনিনি, ধূপকাঠি এনেছি।"
অর্কের কথায় চৈতীর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে।
-- "আনিনি মানে? ডিম না আনলে আজ ভাত খাবি কি দিয়ে শুনি? তুই তো কোনদিনও ঠাকুর ভক্ত ছিলি না। তা ধূপকাঠি আনতে গেলি কেন?"
অর্ক শান্ত কন্ঠে বলে,
-- "মাথা ঠান্ডা করো মা। রাগ করো না। এই ধূপকাঠি আনার কারন, ফেলান।"
চৈতী অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- "ফেলান? সে আবার কে? কি বলছিস আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।"
অর্ক চৈতীকে খাটে বসিয়ে তার পাশে বসে। তারপর বলে,
-- "মা গো আমার সব কথা শুনে বুঝতে পারবে, ফেলান কে। আজ যখন ডিম নিয়ে ফিরছি তখন দেখি একটা বছর দশের ছেলে দেবুদের বাড়ির সামনে দাঁঁড়িয়ে আছে। আর জবা কাকিমা(দেবুর মা) জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তাকে বলছে, 'না না আমি ধূপকাঠি নেব না তুই যা তো এখান থেকে। যতসব চোর ছ্যাঁঁচর আসে জ্বালাতে। সামনেই পুজো, এই এদের ঘুর ঘুরানি এখন বাড়বে। যা, গেলি এখান থেকে!'
বাচ্চাটার চোখ ভর্তি জল দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি ওর কাছে গিয়ে বলি, 'তুই কোথায় থাকিস? তোর নাম কি?'
সে বলে সে পান বস্তিতে থাকে। বাড়িতে অসুস্থ মা আর এক ছোট ভাই ভোলা আছে। আর তার নাম ফেলান।
'তুই এতো ছোট বয়সে ধূপকাঠি বিক্রি করতে বেরিয়েছিস কেন?'
সে বলে, 'কি করবো দাদা, সংসার যে চলে না। ভোলা যে না খেয়ে থাকতে পারে না। আমি বড় হয়ে গিয়েছি তাই মাঝে মাঝে জল খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু ভোলা, সে তো খুব ছোট, কিছুই বুঝতে চায় না।'
আমি অবাক হয়ে যাই ফেলানের কথায়। জান মা, পরিস্থিতি যে ১০ বছরকে প্রাপ্তবয়স্ক করে দিতে পারে তা আজ আমি উপলব্ধি করলাম। ফেলান বললো, 'দাদা ধূপকাঠি নেবে, নাও না, খুব ভালো ধূপকাঠি। খুব ভালো গন্ধ। তোমাদের ঠাকুর খুব খুশী হবে।'
'আমাদের ঠাকুর মানে? ঠাকুর তোর না? ঠাকুর তো সবার।'
'ধুর... কি যে বলো দাদা। ঠাকুর আবার গরীবের হয় নাকি। গরীবের হয় শুধু ভাতের গন্ধ। তোমরা ধূপকাঠি নিলে তোমাদের ঠাকুরকে ধূপের গন্ধ দিলে আমরা ভাতের গন্ধ পাই।'
ওই টুকু ছেলের মুখে এত ভারি ভারি কথা শুনে আমি তো বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ফেলান বলে চলেছে, 'নেবে দাদা নাও না ধূপকাঠি। আজ একটাও বিক্রি হয়নি। ভাইটা যে আর শুধু লবন ভাত খেতে চায় না। আজ ভেবেছিলাম দুটো আলু কিনে নিয়ে যাবো। মা খুব ভালো আলু সেদ্ধ রান্না করে। ভোলা খুব খুশী হবে।'
ফেলানের কথা শুনে আমার দু চোখ ফেটে জল আসে। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, 'তুই স্কুলে পড়িস না?'
পড়ি তো, ক্লাস ফাইভে। ওখানে খিচুড়ি দেয়। আমি খাই আর একটু ভোলার জন্য নিয়ে আসি। জান দাদা শুক্রবার করে স্কুলে ডিমসেদ্ধ দেয়। ওটা আমি মার জন্য নিয়ে আসি। মায়ের যে শরীর ভালো না। ভাত রান্না করে আমাকে আর ভোলাকে সবটা খাইয়ে দেয়। নিজে জল খেয়ে থাকে। মোড়ের মাথার জগা ডাক্তার মাঝে মাঝে আমাদের বস্তিতে যায়। উনি বলেছেন, 'ফেলান, তোর মাকে একটু ভালো জিনিস খাওয়া, না হলে যে তোর মাটা মরে যাবে।'
তাই আমি ডিমটা মার জন্য নিয়ে আসি স্কুল থেকে। ভোলা তো বোঝে না তাই ডিম খাওয়ার বায়না করে। মাও তেমন কিছুতেই পুরোটা খাবে না। বলে এত বড় ডিম কি একা খাওয়া যায়… তাই আমাকে ও ভোলাকে একটু করে দিয়ে নিজে একটু খায়। জান দাদা আমি রোজ স্কুলে যেতে পারি না। রোজ স্কুলে গেলে রোজগার কে করবে? ঘর ভাড়া যে দিতে হয় মাসে একশো টাকা।"
অর্কর কথা শুনতে শুনতে চৈতীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- "তারপর?"
-- "তারপর আমি ফেলানকে নিয়ে দোকানে গিয়ে দুকিলো চাল, দুশো ডাল, পাঁচশো আলু, দুশো তেল আর লবন কিনে দিলাম। আর ছটা ডিমও ওকে দিয়ে বললাম বাড়ি যা। আজ আর এই রোদের মধ্যে ধূপকাঠি বিক্রি করতে হবেনা। মাকে গিয়ে বল সবার জন্য ডিমের ঝোল আর ভাত রান্না করতে। ফেলানের চোখ জলে ভরে ওঠে। সে দুই প্যাকেট ধূপকাঠি আমার হাতে দেয়। আমি নিতে অস্বীকার করলে সে বলে, 'না দাদা এটা তোমায় নিতেই হবে। এতগুলো জিনিস তুমি শুধু শুধু দেবে কেন? আর আমি নেবই বা কেন?'
আমি অবাক হয়ে যাই। বছর দশেকের ফেলানের দিকে তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে ভাবি এ কাকে জবা কাকিমা চোর ছ্যাঁঁচর বলছিলো। এইটুকু ছেলের কি অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ। মা তোমার ঠাকুরকে আজ ফেলানের ধূপ কাঠি দিয়ে পুজো দিও। ওর ধূপের গন্ধ তোমার ঠাকুর পাবে বলেই তো আজ ফেলানরা ভাতের গন্ধ পাবে।"
অর্কর কথায় চৈতী ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। অর্ক চৈতীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
-- "আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ফেলানকে লেখাপড়া শেখাতেই হবে। মা আজ ভালো করে সোয়াবিন রান্না করো তো।"
চৈতী অবাক হয়ে বলে,
-- "তুই তো সোয়াবিন মুখে তুলিস না।"
অর্ক হেসে বলে,
-- "মা তুমি সোয়াবিনটা বড্ড ভালো রাঁধো। তাই আজ আমি ওটাই খাবো।"
এই বলে সে আবার বেরিয়ে পড়ে। ফিরে আসে প্রায় দুই ঘন্টা পরে।
-- "সব সমস্যার সমাধান করে এলাম। ফেলানের বাড়ি খুঁজে বের করে ওর মার সাথে কথা বলে এলাম। ফেলানকে কাল থেকে আমি পড়াতে যাবো। ও স্কুলে যাবে। ও আর ধূপ বিক্রি করবে না।"
চৈতী বলে,
-- "সে কি ওদের চলবে কি করে? ওর মা তো অসুস্থ।"
-- "আমি সেটাই দেখতে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ অসুস্থ। বেশী হাঁঁটা চলা করতে পারেন না। ভারী কাজ করতে পারেন না। কিন্ত বসে বসে শাড়ির ফলস পাড় বসাতে পারবে। ফেরার পথে কয়েকটা দোকানে কথা বলে এসেছি, ওই দোকানগুলোর এখন ফলস পাড় লাগানোর লোকের দরকার, কারন সামনেই পুজো। তোমার পুজোর শাড়ী গুলো বের করে রাখো আমি বিকেলে ফেলানকে পড়াতে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো।"
চৈতী তার ডাক্তারী পাঠরত ২০ বছরের ছেলের দিকে তাকিয়ে ভাবে ছেলের মেধা আর স্বর্গীয় অভিরুপের ইচ্ছেকে, ঈশ্বর ঠিক পথেই নিয়ে গিয়েছেন। মানব দরদী না হলে ডাক্তার হয়ে কি হবে।
আজ দেবী পক্ষের সূচনায় আনন্দে চৈতীর চোখে জল এসে যায়। তার মনে হয় একা একা ছেলেকে হয়তো বা সে সত্যি মানুষের মতোন মানুষ করতে পেরেছে।
একেই বোধহয় আনন্দাশ্রু বলে...
ভাতের_গন্ধ - পর্ণালী_ব্যানার্জী
Reviewed by Pijush Kanti Sarkar
on
November 24, 2020
Rating:
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments: